শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

দর কষাকষির রশিটা যেন ছিঁড়ে না যায়



ড. মাহ্বুবউল্লাহ্
গত ১৫ মে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর পড়ে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম। বাংলা নিউজের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, ‘সংলাপ হতে হলে দুই দলেরই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মন্ত্রিসভায় নিয়মিত বৈঠক শেষে মন্ত্রীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। বৈঠকসূত্র আরও জানায়, আলোচনায় সংলাপে বসার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের দেয়া তাগিদ প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মন্তব্য করেন এবং তিনি হিলারির দক্ষতার প্রশংসা করে বলেন, ‘তিনি (হিলারি) কাকে কী পরামর্শ দিয়েছেন জানি না। তবে সংলাপ হতে হলে দুই দলকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, মন্ত্রিসভায় বৈঠকে কী আলাপ হয়, সে সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানানো না হলে তা কারোরই জানার কথা নয়। দৈনিক নয়া দিগন্তের খবরের সূত্র বাংলা নিউজ। নিশ্চয়ই এই সংবাদ সংস্থাটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে নিউজ হিসেবে রিলিজ করেছে। তবে এ ধরনের কোনো সংবাদ অন্য কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বলে চোখে পড়েনি।
হিলারি ক্লিনটন সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দুই প্রধান পক্ষকেই দিয়েছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেননি, কোন বিরোধীয় বিষয়টি সংলাপের উপজীব্য হবে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা অনুমান করতে পারি, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানটি বিলুপ্ত করার ফলে যে রাজনৈতিক সঙ্কটের উদ্ভব হয়েছে, তা সংলাপের মাধ্যমে নিরসনেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। কারণ এই মুহূর্তে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যে সংঘাতপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি। প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মনে করে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর জন্য কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে জাতির সামনে নেই।
যতই দিন যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচনের সময় ততই ঘনিয়ে আসছে। সুতরাং কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার ফয়সালা হয়ে যাওয়া উচিত। অন্যথায় সঙ্কট বাড়বে, সংঘাত তীব্রতর হবে এবং জাতি চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে। এই পরিস্থিতি কারোই কাম্য হতে পারে না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বিলুপ্ত করার ফলে জাতি এই অনিশ্চয়তার ফাঁদে আটকে পড়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিদ্যমান সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী এনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বিধান পাস করার জন্য শাসকদলকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ সংবিধান সংশোধনের জন্য যে পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা প্রয়োজন, তার চাইতেও অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা শাসকদলের আছে। শাসকদল না চাইলে এই সংশোধনী অনুমোদনের কোনো সুযোগ সৃষ্টি হবে না। সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান এতই নগণ্য যে তাদের পক্ষে অর্থপূর্ণ কিছুই করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিরোধী দল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচনটিকে সব পক্ষের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, সংসদে তাদের অবস্থান ক্ষুদ্র হলেও ভোটের হিসেবে তাদের পেছনে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিপুল অংশের সমর্থন রয়েছে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বিগত সাড়ে ৩ বছরে তাদের জনপ্রিয়তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হারিয়েছে। ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার ভারেই জনপ্রিয়তা হারায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ জনগণকে দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য দিনবদলের জন্য তারা তেমন কিছু করতে পারেনি। বরং দেশ শাসনে প্রায় সব ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা জনগণকে তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। জনসমক্ষে বীর দর্পে তারা যতই হুমকি-ধমকি করুক না কেন তারা নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে তাদের এই দুর্বলতার দিকটি অনুধাবন করতে সক্ষম। কারণ তারা এই দেশেরই মানুষ। এই দেশের রাজনীতির গতিধারা কীভাবে আবর্তিত হয়, তা নিশ্চয়ই তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ভেতর থেকে তারা যতই দুর্বল হয়ে পড়ছে, তাদের মৌখিক আস্ফাালন ও দম্ভোক্তি ততই গগনবিদারী হয়ে উঠছে। এ অবস্থাটি আর যাই হোক শক্তি-সামর্থ্যের পরিচায়ক নয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সমঝোতার পক্ষে মত প্রকাশ করার পরপরই আমরা শুনতে পেলাম আইনমন্ত্রীর উক্তি, তার সেই পুরনো কথা। তিনি বললেন, আদালতের রায় হয়ে হওয়ার পর এ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে আমরা কার কথা বিশ্বাস করব? সরকারের মন্ত্রীরা অহরহ এরকম পরস্পরবিরোধী ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই কৌশল তাদের বিবেচনায় মোক্ষম হলেও বাংলাদেশের জনগণ এত বোকা নয় যে, তারা সরকারের আসল উদ্দেশ্যটি বুঝতে সক্ষম নয়। আসল কথা হলো সরকারের মধ্যে একটি ভয় বাসা বেঁধেছে। ভয়টি হলো ক্ষমতা হারানোর। হয়তো তারা ভাবছেন, আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের ক্ষমতার গদি ছাড়তে হবে। ক্ষমতায় না থাকলে তাদের দুশ্চিন্তা হলো তারা নানারকম নিগ্রহের শিকার হতে পারেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় থাকা বা না থাকা সম্পূর্ণভাবেই জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে এবং এটিকে একটি স্বাভাবিক অবস্থা বলেই মেনে নিতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ দেশে ক্ষমতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যদিকে ক্ষমতাহারা হওয়া মানে নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হওয়া। ক্ষমতায় গেলে নির্বাহী আদেশে মামলা-মোকদ্দমা নিজেদের ওপর থেকে তুলে নেয়া যায়। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের ওপর বিদ্যমান মামলাগুলো শতগুণে সচল করা যায়। এমনকি নতুন নতুন মামলা-মোকদ্দমার বেড়াজালে ফেলে তাদের নাভিশ্বাস তোলা যায়। এমনটিই ঘটেছে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার প্রতিবাদে বিরোধী দলের কয়েকদিনের হরতালকে কেন্দ্র করে। বিরোধী দলের ডাকা হরতালকে কেন্দ্র করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হয়েছে। ইলিয়াস আলীর নিজ এলাকায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারী জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে তিন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এদিকে রাজধানী ঢাকায় হরতাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাস পোড়ানোর মামলা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ককটেল নিক্ষেপের মামলায় বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের ৩৩ নেতা আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিন না পাওয়ায় কারারুদ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে বহু গ্রেফতার ও মামলা-হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একই দিনে একই সঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিককে জেলে পোরার ঘটনা নজিরবিহীন। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দ্রুত বিচার আইনে। এরা যদি শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তাদের চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। অর্থাত্ তারা ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার ফলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমঝোতা ও সংলাপের পরিবেশ সরকার প্রতিহিংসামূলক আচরণের দ্বারা বিনষ্ট করে ফেলছে। মামলা দুটির বিষয়বস্তুর সত্যতা নিয়ে বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলিরা আদালতের কাছে এরই মধ্যে জোরালো যুক্তি উত্থাপন করেছেন। আদালত এইসব যুক্তি আমলে নেবে কিনা সেটা আদালতের ব্যাপার। আমাদের মত দেশে বিচারবিভাগ শাসনবিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত হতে পেরেছে কিনা সে ব্যাপারেও নানা জনের নানা প্রশ্ন। এ দেশের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সমঝোতা কিংবা সংলাপের পরিবেশের জন্য সব পক্ষই চায় মুক্ত পরিবেশে আলোচনা করতে। কোনো পক্ষই তাদের ঘাড়ের ওপর মামলার খড়গ রেখে কিংবা দণ্ডের বোঝা নিয়ে আলোচনায় বসতে চায় না। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো সাংবিধানিক সঙ্কট উত্তরণের জন্য পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান যে গোলটেবিল বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খড়গ কাঁধের ওপর রেখে যোগদান করতে সম্মত হননি। তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে বসার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, সেই প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী যখন বজ্র-নির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, বাস্তিল দুর্গের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনবেন, তখন জনতার যে রুদ্ররোষ সৃষ্টি হয়েছিল তার আঘাতে আইয়ুব খান তার ওপর থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকটি সফল হয়নি, সেটি এক ভিন্ন আলোচনা। এই ঘটনা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, দমনপীড়নের অভিযান জারি রেখে কোনো সমঝোতা বা সংলাপ হয় না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যে সংলাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, সেটি যদি তার অন্তরের কথা হয় তাহলে তাকে অবশ্যই একটি মুক্ত ও সৌন্দর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিরোধী দলকে শিক্ষা দিয়ে বাগে আনার চিন্তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। দর কষাকষির জন্য হার্ডলাইনে পথ বেছে নিতে গিয়ে দর কষাকষির রশিটাই ছিঁড়ে যায় কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে। ইলাস্টিকের মতো দ্রব্য টেনে লম্বা করা যায় বটে, তবে তারও একটা সীমা আছে। আর উভয়পক্ষকে ছাড় দেয়ার যে কথা, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম। উভয়পক্ষ যদি পরস্পরের প্রতি কিছুটা ছাড় দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে সম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে, তার চেয়ে জাতির জন্য এই মুহূর্তে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সফরকারী ভারতের অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখার্জির একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনিও সংলাপের কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ যা চায় সেই অনুযায়ী সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়াই গণতন্ত্রসম্মত। রাজনীতি মানে অত্ঃ ড়ভ পড়সঢ়ত্ড়সরংব। রাজনীতির সেই অত্ঃ-টা যদি বিবদমান সব পক্ষ রপ্ত করতে পারে, তাহলে জয় হবে বাংলাদেশের জনগণের। আমি ভাবতে চাই, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের সব দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জনগণের মুখে হাসিটি দেখতে চান।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com

শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

বিবেকের জয় হোক



ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ্
ছাত্রজীবন ও তত্পরবর্তীকালে বেশকিছুটা সময় রাজনৈতিক সক্রিয়বাদী হিসেবে ভূমিকা পালন করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। একথা সত্য যে, রাজনৈতিক তত্পরতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জ্ঞানার্জনের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। যারা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সবাই সাক্ষ্য দেবেন, পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে সমান তালে নতুন সমাজ নির্মাণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। কীভাবে এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সেটি আমি আন্তরিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিশ্বাসের জন্য আমাকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। অনেক বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, কীভাবে আমার বিরুদ্ধমতের শিক্ষকরা আমার একাডেমিক সাফল্যকে তছনছ করে দিতে চেয়েছেন। সেই ক্ষোভ আমাকে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহী করে তুলেছিল। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, শিক্ষকের কলমও ঘাতকের ছুরিকায় পরিণত হতে পারে। নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতাই আমাকে একদিন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হওয়ার পথ বেছে নিতে প্রণোদিত করে, কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে আমার হৃদয়ের গহীনে জ্ঞানচর্চার প্রবল আকাঙ্ক্ষাটি লুকিয়ে ছিল। আমি ভাবলাম রাজনীতির সক্রিয় মাঠে না থেকেও ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে আমি আমার চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি ভিন্ন এক পথে। সেটা ছিল শিক্ষকতার পথ। ১৯৭৬ সালে দেশে যখন আমাদের মতো স্বদেশ চিন্তায় মগ্ন মানুষদের জন্য রাজনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, আমি তখন রাজনীতিক হওয়ার মোহ ত্যাগ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যোগ দিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সেই থেকে আরও গভীরভাবে জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী হলাম এবং অর্থনীতিশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষাও গ্রহণ করলাম। আমার জীবন নতুন বাঁকে মোড় নিল। আজ অবধি শিক্ষকতার কাজে ব্রতী আছি। তবে আর পাঁচ-দশজন শিক্ষকের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, স্বদেশচিন্তাকে কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। দেশ যখন সঙ্কটে পড়ে তখন আমি উদ্বিগ্ন হই। দেশের সাফল্য দেখে উদ্বেলিত হই।
১৯৬২ থেকে স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বপ্ন দেখেছি। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, এই স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায় তার জন্য পথ খুঁজেছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীনতাই হলো পূর্ববাংলার অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। শুধু স্বাধীনতা নয়, পূর্ববাংলায় একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখেছি। আমি বিশ্বাস করতাম, পূর্ববাংলার আকাশে যে সূর্য উদিত হয় সেই সূর্যের নিচে এদেশের প্রতিটি মানুষ একে অপরের ভাই কিংবা বোন। কেউ কারও প্রভু নয়। ১৯৭০-র ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে আমি ও আমার সহকর্মীরা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার ১১ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করলাম। আজ ভাবতে অবাক লাগে, সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কীভাবে অমন সাহসী হতে পেরেছিলাম। বয়স যত বাড়ছে, যৌবনের দুঃসাহসের কথা ভেবে ততই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি। এই দুঃসাহসিক কাজটি করার পর খুব বেশিদিন কারাগারের বাইরে কাটাতে পারিনি। ২১ মার্চ ১৯৭০ আমাকে গ্রেফতার করা হলো। ২৭ মার্চ ১৯৭০ সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমার বিচার অনুষ্ঠিত হলো। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সামরিক আদালতের বিচারক জনৈক পাকিস্তানি মেজর রায় ঘোষণা করলেন ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১৫ বেত্রদণ্ড। কারাদণ্ড কিংবা বেত্রদণ্ড কিছুই আমাকে ভীত কিংবা শঙ্কিত করতে পারেনি। সামরিক আদালতের একজন কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর আমাকে অনুরোধ করলেন বেত্রদণ্ড মওকুফের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। তিনি আমাকে বললেন, বেত্রদণ্ড যে কী ভয়ঙ্কর তা কি আপনি বোঝেন? আমি বললাম, নিশ্চয়ই বুঝি। কারণ আমার জানা আছে, আইয়ুবী সামরিক শাসনের সময় বেত্রদণ্ডের ফলে কমরেড কাজী আবদুল বারী বধির হয়ে গিয়েছিলেন। আমার দুঃসাহস দেখে কোর্ট ইন্সপেক্টর আর কথা বাড়ালেন না। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই বিশ্বের তাবত্ বেতার মাধ্যমে সংবাদটি প্রচার হয়ে গেল। আমার সৌভাগ্য যে, সেই বেত্রদণ্ড দেশবাসীর প্রতিবাদের মুখে কার্যকর করা সম্ভব হলো না। দেখতে দেখতে এক বছরের কারাদণ্ডের মেয়াদও ফুরিয়ে গেল। কিন্তু আমার কারামুক্তি হলো না। আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা কারারুদ্ধ করে রাখা হলো। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হিংস্রতা ও বর্বরতার সূচনা হলো। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কারাভ্যন্তরে অন্তত তিনবার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমার এবং আরও অনেকের জীবনাবসান ঘটতে পারত। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া, তিনি আমাকে আজও এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে; মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ কিন্তু সম্প্রতি দেশের যে অবস্থা তাতে বলতে পারি না ক’দিন বাঁচব। এমন অনিশ্চিত জীবনের জন্য কি স্বাধীনতার লড়াই করেছিলাম—এই জিজ্ঞাসা বারবার আমার হৃিপণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করে। মহাজোটের অন্যতম শরিক নেতা জনাব রাশেদ খান মেননও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি এবং অন্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সামনে বলেছেন, তিনি নিজেও তার জীবন নিয়ে নিরাপদ বোধ করেন না। এমন স্বাধীন দেশ, এমন আজাদির স্বাদ আমরা কি চেয়েছিলাম? একটি শোষণমুক্ত স্বাধীন স্বদেশভূমির স্বপ্ন এভাবে কেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে? শুধু ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীই নয়—গুম বলি, নিখোঁজ বলি তার তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ। অন্তত আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের মতো দায়িত্বশীল মানবাধিকার সংস্থাগুলোও তাই বলছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও প্রচণ্ড উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আজকের বিশ্ব যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে যেন একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং ব্লগগুলোতে এসব ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার ঘাটতি নেই। সরকারের মন্ত্রীরা এ বিষয়ে একেক সময়ে একেক কথা বলছেন। কখনও মনে হয় হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো আশা যেন উঁকি দিচ্ছে, আবার কখনও মনে হয় কোনো আশা নেই, কোনো ভরসা নেই। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাত্ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু এখন দেশবাসী প্রচণ্ড অধিরতা নিয়ে সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক সমস্যাই থাকতে পারে। যেমন বিদ্যুতের সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের সমস্যা; কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়বে—এমনটি কখনোই কাম্য নয়। জীবন অমূল্য, কারণ একটি জীবনের দীপ প্রজ্বলিত করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই একটি স্বাধীন দেশে এটি একটি অলঙ্ঘনীয় অধিকার। এদেশের সাধারণ মানুষ অনেক অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনায় অভ্যস্ত। দু’বেলা আহার না জুটলে কিংবা সম্মানজনক পরিধেয় না থাকলে মানুষ যতটা না সরকারকে দুষে, তার চেয়েও অধিক দুষে নিজ ভাগ্যকে। এরকম একটি জনগোষ্ঠী অবশ্যই তার সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান সম্পদ জীবনের অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য মনে করলে তাদের কতটা দোষ দেয়া যায়।
সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দেশ আজ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে চলেছে। অনিশ্চিত বলছি এ কারণে যে, অকারণে প্রাণ হরণের মতো ঘটনা ঘটলে এবং তার চাইতে মর্মন্তুদ প্রাণ-হারানো মানুষটির শেষকৃত্য সম্পাদনের সুযোগ না থাকলে যে ক্ষোভ ও ঘৃণার উদ্ভব ঘটবে, তার প্রতিক্রিয়ায় যদি হিংসা-উন্মত্ততার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার পরিণতি আমরা কী করে রুখব? অস্ট্রিয়ার যুবরাজকে হত্যার ঘটনা প্রথম মহাযুদ্ধে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল, তার স্মৃতি এত বছর পরও দগদগে। আজ তাই সব মহলের বোধোদয়ের সময় এসেছে। আমি উপলব্ধি করতে পারি, ক্ষমতাসীন মহলের মধ্যে বহুজন আছেন যারা দেশে কোনো ট্র্যাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব হোক তা কায়মনোবাক্যে চান না। একটি গ্রন্থ রচনা করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে; কিন্তু তার পাণ্ডুলিপি মুহূর্তের মধ্যে দীপশলাকার আগুনে ভস্মীভূত করা সম্ভব। আমাদের এই বাংলাদেশ অযুত প্রাণের বিনিময়ে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য আমাদের অনেককে, যারা বেঁচে আছে, অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই জীবদ্দশায় দেশটি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে—এটা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না। এদেশে বিবেকবান মানুষ আছে। দলীয় আনুগত্যে অন্ধ নন, এমন বুদ্ধিজীবীও অনেকেই রয়েছেন। তাদের সবার কাছে আমার একান্ত নিবেদন—আসুন আমরা মতাদর্শ নির্বিশেষে একজোট হয়ে উচ্চারণ করি : বাংলাদেশে মানুষের জীবনের মূল্য হোক সব মূল্যের ঊর্ধ্বে। কারোর ভুল বা বিচ্যুতির জন্য দেশটিকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই না—কারণ কী ক্ষমতাসীন, কী ক্ষমতাবহির্ভূত কারোরই কোনো মঙ্গল নেই এতে। বিবেকের জয় হোক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mail: mahbub.ullah@yahoo.com