শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

বিবেকের জয় হোক



ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ্
ছাত্রজীবন ও তত্পরবর্তীকালে বেশকিছুটা সময় রাজনৈতিক সক্রিয়বাদী হিসেবে ভূমিকা পালন করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। একথা সত্য যে, রাজনৈতিক তত্পরতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জ্ঞানার্জনের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। যারা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সবাই সাক্ষ্য দেবেন, পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে সমান তালে নতুন সমাজ নির্মাণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। কীভাবে এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সেটি আমি আন্তরিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিশ্বাসের জন্য আমাকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। অনেক বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, কীভাবে আমার বিরুদ্ধমতের শিক্ষকরা আমার একাডেমিক সাফল্যকে তছনছ করে দিতে চেয়েছেন। সেই ক্ষোভ আমাকে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহী করে তুলেছিল। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, শিক্ষকের কলমও ঘাতকের ছুরিকায় পরিণত হতে পারে। নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতাই আমাকে একদিন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হওয়ার পথ বেছে নিতে প্রণোদিত করে, কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে আমার হৃদয়ের গহীনে জ্ঞানচর্চার প্রবল আকাঙ্ক্ষাটি লুকিয়ে ছিল। আমি ভাবলাম রাজনীতির সক্রিয় মাঠে না থেকেও ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে আমি আমার চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি ভিন্ন এক পথে। সেটা ছিল শিক্ষকতার পথ। ১৯৭৬ সালে দেশে যখন আমাদের মতো স্বদেশ চিন্তায় মগ্ন মানুষদের জন্য রাজনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, আমি তখন রাজনীতিক হওয়ার মোহ ত্যাগ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যোগ দিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সেই থেকে আরও গভীরভাবে জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী হলাম এবং অর্থনীতিশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষাও গ্রহণ করলাম। আমার জীবন নতুন বাঁকে মোড় নিল। আজ অবধি শিক্ষকতার কাজে ব্রতী আছি। তবে আর পাঁচ-দশজন শিক্ষকের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, স্বদেশচিন্তাকে কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। দেশ যখন সঙ্কটে পড়ে তখন আমি উদ্বিগ্ন হই। দেশের সাফল্য দেখে উদ্বেলিত হই।
১৯৬২ থেকে স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বপ্ন দেখেছি। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, এই স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায় তার জন্য পথ খুঁজেছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীনতাই হলো পূর্ববাংলার অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। শুধু স্বাধীনতা নয়, পূর্ববাংলায় একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখেছি। আমি বিশ্বাস করতাম, পূর্ববাংলার আকাশে যে সূর্য উদিত হয় সেই সূর্যের নিচে এদেশের প্রতিটি মানুষ একে অপরের ভাই কিংবা বোন। কেউ কারও প্রভু নয়। ১৯৭০-র ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে আমি ও আমার সহকর্মীরা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার ১১ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করলাম। আজ ভাবতে অবাক লাগে, সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কীভাবে অমন সাহসী হতে পেরেছিলাম। বয়স যত বাড়ছে, যৌবনের দুঃসাহসের কথা ভেবে ততই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি। এই দুঃসাহসিক কাজটি করার পর খুব বেশিদিন কারাগারের বাইরে কাটাতে পারিনি। ২১ মার্চ ১৯৭০ আমাকে গ্রেফতার করা হলো। ২৭ মার্চ ১৯৭০ সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমার বিচার অনুষ্ঠিত হলো। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সামরিক আদালতের বিচারক জনৈক পাকিস্তানি মেজর রায় ঘোষণা করলেন ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১৫ বেত্রদণ্ড। কারাদণ্ড কিংবা বেত্রদণ্ড কিছুই আমাকে ভীত কিংবা শঙ্কিত করতে পারেনি। সামরিক আদালতের একজন কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর আমাকে অনুরোধ করলেন বেত্রদণ্ড মওকুফের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। তিনি আমাকে বললেন, বেত্রদণ্ড যে কী ভয়ঙ্কর তা কি আপনি বোঝেন? আমি বললাম, নিশ্চয়ই বুঝি। কারণ আমার জানা আছে, আইয়ুবী সামরিক শাসনের সময় বেত্রদণ্ডের ফলে কমরেড কাজী আবদুল বারী বধির হয়ে গিয়েছিলেন। আমার দুঃসাহস দেখে কোর্ট ইন্সপেক্টর আর কথা বাড়ালেন না। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই বিশ্বের তাবত্ বেতার মাধ্যমে সংবাদটি প্রচার হয়ে গেল। আমার সৌভাগ্য যে, সেই বেত্রদণ্ড দেশবাসীর প্রতিবাদের মুখে কার্যকর করা সম্ভব হলো না। দেখতে দেখতে এক বছরের কারাদণ্ডের মেয়াদও ফুরিয়ে গেল। কিন্তু আমার কারামুক্তি হলো না। আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা কারারুদ্ধ করে রাখা হলো। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হিংস্রতা ও বর্বরতার সূচনা হলো। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কারাভ্যন্তরে অন্তত তিনবার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমার এবং আরও অনেকের জীবনাবসান ঘটতে পারত। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া, তিনি আমাকে আজও এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে; মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ কিন্তু সম্প্রতি দেশের যে অবস্থা তাতে বলতে পারি না ক’দিন বাঁচব। এমন অনিশ্চিত জীবনের জন্য কি স্বাধীনতার লড়াই করেছিলাম—এই জিজ্ঞাসা বারবার আমার হৃিপণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করে। মহাজোটের অন্যতম শরিক নেতা জনাব রাশেদ খান মেননও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি এবং অন্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সামনে বলেছেন, তিনি নিজেও তার জীবন নিয়ে নিরাপদ বোধ করেন না। এমন স্বাধীন দেশ, এমন আজাদির স্বাদ আমরা কি চেয়েছিলাম? একটি শোষণমুক্ত স্বাধীন স্বদেশভূমির স্বপ্ন এভাবে কেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে? শুধু ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীই নয়—গুম বলি, নিখোঁজ বলি তার তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ। অন্তত আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের মতো দায়িত্বশীল মানবাধিকার সংস্থাগুলোও তাই বলছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও প্রচণ্ড উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আজকের বিশ্ব যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে যেন একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং ব্লগগুলোতে এসব ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার ঘাটতি নেই। সরকারের মন্ত্রীরা এ বিষয়ে একেক সময়ে একেক কথা বলছেন। কখনও মনে হয় হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো আশা যেন উঁকি দিচ্ছে, আবার কখনও মনে হয় কোনো আশা নেই, কোনো ভরসা নেই। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাত্ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু এখন দেশবাসী প্রচণ্ড অধিরতা নিয়ে সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক সমস্যাই থাকতে পারে। যেমন বিদ্যুতের সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের সমস্যা; কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়বে—এমনটি কখনোই কাম্য নয়। জীবন অমূল্য, কারণ একটি জীবনের দীপ প্রজ্বলিত করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই একটি স্বাধীন দেশে এটি একটি অলঙ্ঘনীয় অধিকার। এদেশের সাধারণ মানুষ অনেক অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনায় অভ্যস্ত। দু’বেলা আহার না জুটলে কিংবা সম্মানজনক পরিধেয় না থাকলে মানুষ যতটা না সরকারকে দুষে, তার চেয়েও অধিক দুষে নিজ ভাগ্যকে। এরকম একটি জনগোষ্ঠী অবশ্যই তার সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান সম্পদ জীবনের অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য মনে করলে তাদের কতটা দোষ দেয়া যায়।
সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দেশ আজ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে চলেছে। অনিশ্চিত বলছি এ কারণে যে, অকারণে প্রাণ হরণের মতো ঘটনা ঘটলে এবং তার চাইতে মর্মন্তুদ প্রাণ-হারানো মানুষটির শেষকৃত্য সম্পাদনের সুযোগ না থাকলে যে ক্ষোভ ও ঘৃণার উদ্ভব ঘটবে, তার প্রতিক্রিয়ায় যদি হিংসা-উন্মত্ততার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার পরিণতি আমরা কী করে রুখব? অস্ট্রিয়ার যুবরাজকে হত্যার ঘটনা প্রথম মহাযুদ্ধে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল, তার স্মৃতি এত বছর পরও দগদগে। আজ তাই সব মহলের বোধোদয়ের সময় এসেছে। আমি উপলব্ধি করতে পারি, ক্ষমতাসীন মহলের মধ্যে বহুজন আছেন যারা দেশে কোনো ট্র্যাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব হোক তা কায়মনোবাক্যে চান না। একটি গ্রন্থ রচনা করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে; কিন্তু তার পাণ্ডুলিপি মুহূর্তের মধ্যে দীপশলাকার আগুনে ভস্মীভূত করা সম্ভব। আমাদের এই বাংলাদেশ অযুত প্রাণের বিনিময়ে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য আমাদের অনেককে, যারা বেঁচে আছে, অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই জীবদ্দশায় দেশটি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে—এটা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না। এদেশে বিবেকবান মানুষ আছে। দলীয় আনুগত্যে অন্ধ নন, এমন বুদ্ধিজীবীও অনেকেই রয়েছেন। তাদের সবার কাছে আমার একান্ত নিবেদন—আসুন আমরা মতাদর্শ নির্বিশেষে একজোট হয়ে উচ্চারণ করি : বাংলাদেশে মানুষের জীবনের মূল্য হোক সব মূল্যের ঊর্ধ্বে। কারোর ভুল বা বিচ্যুতির জন্য দেশটিকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই না—কারণ কী ক্ষমতাসীন, কী ক্ষমতাবহির্ভূত কারোরই কোনো মঙ্গল নেই এতে। বিবেকের জয় হোক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mail: mahbub.ullah@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন