শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

সুযোগ এখন প্রধানমন্ত্রীর করতলে



ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ্
গত ২ জুন দৈনিক আমার দেশ-এ ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি রক্ষা পায়’ শিরোনামের কলামটি ছাপা হয়েছিল। এই লেখার সর্বশেষ লাইনটি ছিল, ‘তবে এটুকু বুঝতে পারছি, ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যা কিছু চত্বফরপঃ করতে পেরেছি, এখন সেরকম কিছু করতে পারা প্রায় অসম্ভব।’ আমরা যে একটা অনিশ্চিত সময় পার করছি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনীতি শাস্ত্রে একটি কথা আছে—ঝুঁকি সম্পর্কে চত্ড়নধনরষরঃু বা সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে হিসাব কষে কিছু বলা যায়, কিন্তু অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রে সেরকম কিছু বলা যায় না। তাই অনিশ্চয়তা একেবারেই পরিমাপযোগ্য নয়।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে সর্বশেষ পরিণতি কীভাবে আসতে পারে সে সম্পর্কে জোরালোভাবে আঁচ-অনুমান করা সহজতর ছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি এতই জটিল যে এই পরিস্থিতির গর্ভ থেকে কেমন সন্তানের জন্ম হবে, সে সম্পর্কে ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গুনার মির্ডালের ভাষায় একটি ঝড়ভঃ ংঃধঃব বা কোমল রাষ্ট্র বলা যায়। এরকম একটি রাষ্ট্রে দেশের ভেতরের এবং বাইরের অনেক ধরনের কুশীলবরা তত্পর থাকে। তাদের বহুমুখী তত্পরতা শেষ পর্যন্ত দেশটিকে কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে, তা বলার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা আমার আছে বলে মনে হয় না। কারণ কোনো একজন অপঃড়ত্ কিছু একটা করতে চাইলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অপঃড়ত্ বা অপঃড়ত্-রা উল্টো চাল চালে। এর ফলে অবিরত ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। শেষ ফল যা আসে তা হয়তো এসব অগণিত ক্রিয়া-বিক্রিয়ারই একটি পরিণতি। কিন্তু ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলোর প্রতিটি ধাপ বা পর্যায় চয়ন করে চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে বলা সত্যিই কঠিন। কারণ বিষয়টি ঈযবসরংঃত্ু বা রসায়ন শাস্ত্র নয়, যেখানে সমাজবদ্ধ মানুষের মনে নিরন্তর নানামুখী প্রবণতার সৃষ্টি হয় এবং তারই সমান্তরালে রাষ্ট্রবহির্ভূত অপঃড়ত্-রাও নানামুখী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, সেখানে রসায়ন শাস্ত্রের মতো কোনো সিদ্ধান্তে আসা সত্যিই দুরূহ।
অস্বীকার করার উপায় নেই বাংলাদেশ এই মুহূর্তে তিনটি বৃহত্ শক্তির স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। শক্তিগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং গণচীন। এছাড়াও রয়েছে আরও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ বহিঃশক্তি, যেমন—সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং মিয়ানমার। বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা কম নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর মতো সামরিক জোট তো রয়েছেই। অন্যদিকে ভারত ও চীন দুটি উদীয়মান শক্তি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল অভিন্ন সীমান্ত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ভারতকে নিয়ে এদেশের মানুষের উদ্বেগের পরিমাণও কম নয়। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে আস্থার সঙ্কট। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থের বিচারে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত সমস্যার তালিকাটিও দীর্ঘ। এতকিছুর পরও বাংলাদেশ সরাসরি ভারতের বৈরিতার ব্যয় বহনে সক্ষম নয়, কারণ ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বন্ধু নির্বাচন করা গেলেও প্রতিবেশী নির্বাচন করা যায় না, এটি এক নিষ্ঠুর সত্য। গণচীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেকে একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। গণচীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। গণচীনের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও হিসাবের মধ্যে নিতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বাস্তবতাকে অবহেলা করতে পারে না। গণচীন ভারতের মতো বাংলাদেশের সীমান্ত সন্নিবিষ্ট রাষ্ট্র না হলেও এর ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের খুবই কাছাকাছি।
বাংলাদেশের সঙ্গে গণচীনের স্বাভাবিক বাণিজ্যিক লেনদেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৭৫-এ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তবে কখনও কখনও যে টানাপড়েনের ঘটনা ঘটেনি, এমনটি বলা যাবে না। গণচীনের Department of Policy Planning, Ministry of Foreign Affairs থেকে প্রকাশিত China’s Foreign Affairs-2011 গ্রন্থের বাংলাদেশ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে, Military-to-military exchanges and cooperation produced tangible outcome. গণচীন এখন বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়াল রেলসড়ক নির্মাণে আগ্রহী। এ দুটি অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মাণে যদি বাংলাদেশ ও চীন সরকার সম্মত হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে। শীতল যুদ্ধের সময় আটলান্টিক মহাসাগর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রণনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ভারত মহাসাগর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে আটলান্টিকের চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরেরই অংশ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাংলাদেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভারত এখনও ভারত মহাসাগরকে ইন্ডিয়ান লেক হিসেবেই দেখতে চায়। ভারতের আশঙ্কা, গণচীন পাকিস্তানের গুরাদর এবং শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে এবং বাংলাদেশেও আরেকটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উত্সাহ প্রকাশ করে ভারতকে জরহম ড়ভ চবধত্ষ দিয়ে আবদ্ধ করে ফেলতে চাইছে। গণচীনেরও আশঙ্কা, তার উচ্চ অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য জ্বালানি তেলের সরবরাহ ভারত মহাসাগর দিয়ে অব্যাহত রাখা ভবিষ্যতে নানামুখী সামরিক বাধার সম্মুখীন হতে পারে। এজন্যই গণচীন তার জাতীয় স্বার্থে জ্বালানি তেল সরবরাহ ঝুঁকির মুখে ফেলতে চায় না। এভাবে বিভিন্ন শক্তির স্বার্থ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নিলে আমাদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, আমরা এখন বিপরীতমুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই অবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে কারও শত্রুতার মুখোমুখি না হয়ে নীতিনির্ধারণ করা সত্যিই কঠিন। আমাদের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হচ্ছে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি একসময় বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে পরিণত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। এখন দেখার বিষয় তদীয় দুহিতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবার প্রত্যয়কে সমুন্নত রাখতে কী পদক্ষেপ নেন। তবে তার সরকার যে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি, তা একরকম বলা যায়।
বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহী বহিঃশক্তিগুলোর পারস্পরিক অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ঘটনাপ্রবাহের ওপর উল্লেখযোগ্য ছাপ ফেলবে বলে ধারণা করা যায়। জ্যামিতি শাস্ত্রে আছে, ত্রিভুজের দুটি বাহুর যোগফল তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর। যে ৩টি প্রধান বহিঃশক্তির কথা আলোচনা করা হলো সেগুলোর দুটির মধ্যে যদি কোনো বোঝাপড়া হয় তাহলে হয়তো বাংলাদেশকে সেই পথেই এগুতে হবে। কারণ বাংলাদেশে এখনও এমন কোনো জনঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটেনি যে শক্তি এ ধরনের বোঝাপড়াকে আমলে না নিয়ে শুধু স্বদেশের স্বার্থের কথা ভেবে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে। এটা আমাদের জাতীয় দুর্বলতা। অতি সম্প্রতি ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ‘বাংলাদেশ : ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রত্যাশায় ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণ বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু দলটি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গতানুগতিক ধারায় ফিরে যায় এবং দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এ কারণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যায়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দেশটির রাজপথে সহিংস বিক্ষোভ অব্যাহত থাকতে পারে। ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা সিডনি জোনস বলেন, সমঝোতার সামান্য সুযোগ এখনও রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বিরোধী দলের কাছাকাছি পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচনে একচ্ছত্র জয় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলটিকে নিয়ে দেশের জনগণের মোহ গত ৩ বছরেই কেটে গেছে। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেয় এবং বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সংবাদ মাধ্যম, নিরাপত্তাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর সরকার বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করে। আগামী নির্বাচন নিয়ে যে কোনো ধরনের অচলাবস্থার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর রাজধানীতে সহিংসতা চলতে থাকলে পূর্ণমাত্রায় সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা না থাকলেও সামরিক হস্তক্ষেপ জনসমর্থন পেতে পারে। ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পল কিন জজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সুযোগ একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। তবে এজন্য রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপির আটক নেতাদের মুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উদ্যোগের সূচনা করতে পারেন। অন্যথায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও সেই হুমকির মধ্যে পড়বে।
এই কলাম যখন লিখছিলাম তখনই সংবাদ পেলাম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য কয়েকজন নেতা জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বিএনপি সহিংসতাকে এড়াতে চায় বলেই সরকারকে গত ১১ জুন আরও সময় দিয়েছে। এখন সমঝোতায় পৌঁছানোর সুবর্ণ সুযোগটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার করতলে অবস্থান করছে। আশা করি তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া না করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের অশুভ আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করবেন। তার জন্যই সেই মহান উক্তিটি স্মরণ করি : চবধপব যধঃয যবত্ ারপঃড়ত্রবং সড়ত্ব মষড়ত্রড়ঁং ঃযধহ ঃযধঃ ড়ভ ধিত্.
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mail: mahbub.ullah@yahoo.com

শুক্রবার, ১ জুন, ২০১২

নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি রক্ষা পায়


ড. মাহ্বুবউল্লাহ্
আমার পেশা শিক্ষকতা। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস-পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট এবং পরামর্শ দানের কাজে আমাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে আমার বৃত্তবহির্ভূত মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কিংবা মতবিনিময়ের সুযোগ খুব কমই থাকে। এসব ব্যস্ততার ফাঁকে যাদের সঙ্গেই আমার সাক্ষাত্ ঘটে, তাদের প্রত্যেকেরই একটি জিজ্ঞাসা—দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে। পরিস্থিতির মধ্যে অনিশ্চয়তার উপাদানগুলো এতই ব্যাপক যে আমার পক্ষে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না, কী ঘটতে পারে। আমরা সবাই জানি, কালপ্রবাহে ভবিষ্যত্ অনিশ্চয়তায় ভরপুর। অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও চত্বফরপঃরড়হ ঝপরবহপব-এর বদৌলতে ভবিষ্যত্ সম্পর্কে অনেকাংশে ঐরময চত্ড়নধনরষরঃু বা উচ্চ সম্ভাবনা নিয়ে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। ১৯৭০-৭১ সালে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচি উত্থাপনের অপরাধে সামরিক আদালতের দণ্ড মাথায় নিয়ে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারুদ্ধ ছিলাম। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের গণহত্যার সূচনায় পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বাইরের ঘটনাবলীর সঙ্গে আমার কিংবা আমার সহবন্দীদের কারোরই যোগাযোগ ছিল না। তবে রাজবন্দী হিসেবে কিছু সংবাদপত্র পাঠ করার স্বাধীনতা আমাদের ছিল। সেসব সংবাদপত্রেরও যেসব খবর আপত্তিকর মনে হতো সেগুলো কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের গোচরে না আসা নিশ্চিত করার জন্য কালো কালি দিয়ে লেপ্টে দিত। এসব সেন্সর করা খবরের বেশিরভাগই ছিল বন্দী সংক্রান্ত বিষয়াবলী। রাজনৈতিক খবরগুলো সেন্সরের আওতায় আনা হতো না। আমরা অবরুদ্ধ পূর্ব বাংলার কয়েকটি দৈনিক পেতাম। যেমন—দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার এবং পুড়িয়ে দেয়ার পর আবার প্রকাশনার মুখ দেখতে পাওয়া দৈনিক ইত্তেফাক। এছাড়াও ছিল দৈনিক পাকিস্তান। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন আবিদুর রহমানের মালিকানাধীন দ্য পিপল এবং দৈনিক সংবাদ আদৌ প্রকাশিত হতে পারেনি। এছাড়া বোনাস হিসেবে পেতাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত দ্য ডন এবং পাকিস্তান টাইমস। অবরুদ্ধ পূর্ব বাংলায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো কিছুটা হলেও বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, সেই সংবাদপত্রগুলোও সেন্সরের খড়গমুক্ত ছিল না। কারণ ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যাতে পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ কোনোক্রমেই পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম নিপীড়নের কথা জানতে না পারে। সরকারের প্রচারণার একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হলো পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের ইন্ধনে মুষ্টিমেয় কিছু লোক দেশদ্রোহিতামূলক কার্যকলাপ চালাচ্ছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা সংবাদপত্র পাঠ করে জানতে পারছিলাম অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কী প্রতিক্রিয়া ঘটছে। এছাড়া ভারতে আশ্রয় নেয়া পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের নিয়ে জাতিসংঘ ও বিশ্ব নেতাদের উদ্বেগ প্রকাশ থেকেও আমরা বুঝতে পারছিলাম, শুধু প্রাণরক্ষার তাগিদে লাখ লাখ লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা আরও জানতে পেরেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবস্থান কী, জানতে পেরেছিলাম জাতিসংঘকেন্দ্রিক কূটনৈতিক তত্পরতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকারের সঙ্গে সে দেশের সুধী সমাজ, মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ জনগণের মতপার্থক্যের বিষয়গুলো।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তখন একজন ডেপুটি জেলার ছিলেন। তার নাম সামশুর রাহমান। তিনি হয়তো আজ আর বেঁচে নেই। আপাদমস্তক ভদ্রলোক এই মানুষটির রাজবন্দীদের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাশীল হওয়ার সুনাম ছিল। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আমাকে একদিন একান্তে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেশে কী হতে যাচ্ছে’। আমার প্রতি তার এক ধরনের স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল। জানি না কী কী করে তার মধ্যে একটি বিশ্বাস দানা বেঁধেছিল যে, বয়সে অতি তরুণ এই বন্দীটি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক থেকে প্রখর চেতনাসম্পন্ন। সংবাদপত্র পাঠের মাধ্যমে আমি নিজের মধ্যে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তুলতে সক্ষম হই। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলোতে ‘দুষ্কৃতকারী’দের সঙ্গে সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনীর গোলাগুলি বিনিময় বা সংঘর্ষের খবরও বেরুত। কখনও কখনও কতজন ‘দুষ্কতৃকারী’ নিহত হয়েছে কিংবা ধরা পড়েছে, সে খবরও বেরুত। জেলে বাঙালি ওয়ার্ডেনরাও দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাকশন সম্পর্কে খবরাখবর দিত। এক সময় শুনতে পেলাম, তরুণ বাঙালিদের জোর করে ধরে নিয়ে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত নিয়ে নেয়া হতো। এতে বুঝতে পারলাম, আহত পাকিস্তানি সৈন্যদের দেহে রক্ত সরবরাহের জন্যই এই ঘৃণ্য কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে। এই অভিযানে অনেক বাঙালি নাগরিককে প্রাণ হারাতে হতো। ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কাউকে কাউকে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হতো, তারাও একান-ওকানে ভর করে সামরিক নির্যাতনের কুঠুরির দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা আমাদের কানে পৌঁছে দিত। এসব খবর ছাড়াও একটি উদ্বেগজনক খবর আমার মতো রাজবন্দীদের অত্যন্ত বিচলিত করেছিল। সেটা হলো, বাম ঘরানার মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর মুজিব বাহিনীর নিধন অভিযান। আমরা আশা করেছিলাম, সব দল ও মতের মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমির মুক্তির জন্য একাট্টা হয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বে। বুঝতে পারলাম, মুক্তিযুদ্ধের ভেতরেও একটা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে। এসব ছন্দপতন সত্ত্বেও বুঝতে বাকি রইল না, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।।
ডেপুটি জেলার সামশুর রহমান সাহেবের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যমান পরিস্থিতির নিরিখে আমার জবাব ছিল, ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর মধ্যে ভারতীয় সামরিক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবে। তারপর আমরা কতটুকু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব, সে সম্পর্কে তখনই কিছু বলতে চাইনি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশের ৪১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষ কতটুকু স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করেছে, সেটা এ দেশের জনগণ বিলক্ষণ জানে ও বোঝে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের পর জেলার থেকে শুরু করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সব কর্মকর্তা রাজবন্দীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে ছুটে এলেন। জলযোগের জন্য নিয়ে এলেন কয়েক প্যাকেট মিষ্টি। এতদিন তারা পূর্ণ আনুগত্যের সঙ্গেই পাকিস্তানি সামরিক সরকারের হুকুম তামিল করেছেন। সামশুর রহমান সাহেব আমাকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কী করে প্রায় নির্ভুলভাবে পাকিস্তানিদের পরাজয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন? আপনার মধ্যে কি কোনো ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি কাজ করে? আমার সাফ জবাব ছিল—এসব বোঝার জন্য পীর, ফকির কিংবা জ্যোতিষী হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু একটি ক্ষমতা। সেটি হলো রাজনৈতিক সমীকরণগুলো মেলাতে পারার সক্ষমতা। কিন্তু আজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে সেই আমি কোনো সমীকরণই যেন মেলাতে পারছি না। যতই দিন যাচ্ছে, সরকারের মেয়াদ ততই ফুরিয়ে আসছে। মেয়াদ শেষ হলে বর্তমান সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সাংবিধানিক কারণেই সম্ভব হবে না। কিন্তু পলিটিক্যাল পাওয়ারের ট্রানজিশনটি কীভাবে ঘটবে তা নিয়ে চলছে চরম অচলাবস্থা। বিরোধী দল জানিয়ে দিয়েছে তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন করবে না, নির্বাচন হতে দেবে না। অপরদিকে সরকারি দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাফ কথা, কোনো অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। এই দুই বিপরীত মেরুমুখী অবস্থানের সমাধান কী? বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধুদের মুখ থেকে যে কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো. নির্বাচনটি হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য, ন্যায্য এবং সব পক্ষের অংশগ্রহণমূলক। তারা খোলাখুলি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলেনি। তাদের কূটনৈতিক ভাষায় চয়নকৃত বাক্যাবলীর অর্থভেদ করলে যা বোঝা যায় সেটি হলো, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন। এমনকি ভারতের অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখার্জিও বলেছেন, গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট হলো দেশের জনগণ যেভাবে চায় সে পথেই চলা। মোটামুটিভাবে বলা যায়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি এখন আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। এরকম একটি প্রায় অনিষ্পন্নযোগ্য দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর একটি বিধান। এই বিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার ৩ মাস আগে। অর্থাত্ বিদ্যমান সংসদের সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন। এর ফলে একদিকে যেমন তারা নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাশী একই দলের সংসদ সদস্য এবং অসদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেবে। দেখা দেবে বিশাল বিশৃঙ্খলা। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে ফয়সালায় আসার জন্য ৩ মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। ১০ জুন সেই সময়সীমা অতিক্রান্ত হবে। এরই মধ্যে তার দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কারারুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। আপস সমঝোতা হতে হলে দমন-পীড়নমূলক অবস্থার ইতি ঘটিয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু তারও কোনো লক্ষণ নেই। সরকারের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, কূটনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় Brinkmanship, সে পথই সরকার বেছে নিয়েছে। পুরো ব্যাপারটি উভয় পক্ষের জন্য একটি স্নায়ুশক্তির পরীক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চরম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করার এই নীতি দেশের জন্য যে মঙ্গলজনক নয়, তা বলাই বাহুল্য। এরই মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বসেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যদি চ্যালেঞ্জ-কাউন্টার চ্যালেঞ্জ চলতে থাকে এবং তার পাশাপাশি যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে তাহলে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তা থেকে কোনো পক্ষেরই রেহাই পাওয়া সহজ হবে না। কথায় বলে, নগরে যদি আগুন লাগে তাহলে দেবালয় কি রক্ষা পায়? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাহেব বলেছেন, সংলাপ না হলে যুদ্ধ হবে। তিনি হয়তো সংলাপের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই এই উক্তিটি করেছেন। আমাদের সোনার দেশে ভালোমন্দ মিশিয়ে গত ৪১ বছরে যা কিছু অর্জন, সেটা তো আমরা যুদ্ধের আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাই হতে দিতে পারি না। মানুষ যে প্রশ্ন করছে দেশে কী হবে, সেই উত্কণ্ঠার অবসান এক নিমিষেই হয়ে যেতে পারে সংলাপ শুরু হলে। রাজনীতিতে যারা ক্ষমতাবান, যাদের হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি তারা যদি একটু ছাড় দিয়েই সংলাপের পথ সুগম করতে পারেন, তাহলে তারা হেরে গেছেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। গণতান্ত্রিক দেশে বেশিরভাগ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো গৌরবের, অগৌরবের নয়। ১৯৯৬ সালে বিএনপিও সংবিধানের অজুহাত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদ বাতিল করে একটি নির্বাচন দিয়ে একতরফাভাবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি পাস করেছিল বলেই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ১১৬টি আসন পেয়ে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে অবতীর্ণ হতে পেরেছিল। কোয়ালিশন গঠনের খেলায় হেরে না গেলে তাদের পক্ষে সরকার গঠন অসম্ভব কিছু হতো না। আজ এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তা দেখে মনে হয়, শাসক আওয়ামী লীগ দলের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। একটি পথ হলো ধনুর্ভঙ্গপণ করে বিরোধী দলের দাবিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা অথবা আপসরফায় পৌঁছে নিজেদের জন্য ইতিহাসে একটি সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করা। এখন তারা কী করবে এটা তাদেরই বিবেচনার বিষয়। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যা কিছু Predict করতে পেরেছি, এখন সেরকম কিছু করতে পারা প্রায় অসম্ভব।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

দর কষাকষির রশিটা যেন ছিঁড়ে না যায়



ড. মাহ্বুবউল্লাহ্
গত ১৫ মে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর পড়ে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম। বাংলা নিউজের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, ‘সংলাপ হতে হলে দুই দলেরই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মন্ত্রিসভায় নিয়মিত বৈঠক শেষে মন্ত্রীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। বৈঠকসূত্র আরও জানায়, আলোচনায় সংলাপে বসার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের দেয়া তাগিদ প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মন্তব্য করেন এবং তিনি হিলারির দক্ষতার প্রশংসা করে বলেন, ‘তিনি (হিলারি) কাকে কী পরামর্শ দিয়েছেন জানি না। তবে সংলাপ হতে হলে দুই দলকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, মন্ত্রিসভায় বৈঠকে কী আলাপ হয়, সে সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানানো না হলে তা কারোরই জানার কথা নয়। দৈনিক নয়া দিগন্তের খবরের সূত্র বাংলা নিউজ। নিশ্চয়ই এই সংবাদ সংস্থাটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে নিউজ হিসেবে রিলিজ করেছে। তবে এ ধরনের কোনো সংবাদ অন্য কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বলে চোখে পড়েনি।
হিলারি ক্লিনটন সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দুই প্রধান পক্ষকেই দিয়েছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেননি, কোন বিরোধীয় বিষয়টি সংলাপের উপজীব্য হবে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা অনুমান করতে পারি, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানটি বিলুপ্ত করার ফলে যে রাজনৈতিক সঙ্কটের উদ্ভব হয়েছে, তা সংলাপের মাধ্যমে নিরসনেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন হিলারি ক্লিনটন। কারণ এই মুহূর্তে সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে যে সংঘাতপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি। প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল মনে করে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর জন্য কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে জাতির সামনে নেই।
যতই দিন যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচনের সময় ততই ঘনিয়ে আসছে। সুতরাং কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার ফয়সালা হয়ে যাওয়া উচিত। অন্যথায় সঙ্কট বাড়বে, সংঘাত তীব্রতর হবে এবং জাতি চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে। এই পরিস্থিতি কারোই কাম্য হতে পারে না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বিলুপ্ত করার ফলে জাতি এই অনিশ্চয়তার ফাঁদে আটকে পড়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বিদ্যমান সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী এনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বিধান পাস করার জন্য শাসকদলকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ সংবিধান সংশোধনের জন্য যে পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা প্রয়োজন, তার চাইতেও অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা শাসকদলের আছে। শাসকদল না চাইলে এই সংশোধনী অনুমোদনের কোনো সুযোগ সৃষ্টি হবে না। সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান এতই নগণ্য যে তাদের পক্ষে অর্থপূর্ণ কিছুই করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিরোধী দল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচনটিকে সব পক্ষের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, সংসদে তাদের অবস্থান ক্ষুদ্র হলেও ভোটের হিসেবে তাদের পেছনে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিপুল অংশের সমর্থন রয়েছে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বিগত সাড়ে ৩ বছরে তাদের জনপ্রিয়তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হারিয়েছে। ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার ভারেই জনপ্রিয়তা হারায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ জনগণকে দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য দিনবদলের জন্য তারা তেমন কিছু করতে পারেনি। বরং দেশ শাসনে প্রায় সব ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা জনগণকে তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। জনসমক্ষে বীর দর্পে তারা যতই হুমকি-ধমকি করুক না কেন তারা নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে তাদের এই দুর্বলতার দিকটি অনুধাবন করতে সক্ষম। কারণ তারা এই দেশেরই মানুষ। এই দেশের রাজনীতির গতিধারা কীভাবে আবর্তিত হয়, তা নিশ্চয়ই তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ভেতর থেকে তারা যতই দুর্বল হয়ে পড়ছে, তাদের মৌখিক আস্ফাালন ও দম্ভোক্তি ততই গগনবিদারী হয়ে উঠছে। এ অবস্থাটি আর যাই হোক শক্তি-সামর্থ্যের পরিচায়ক নয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সমঝোতার পক্ষে মত প্রকাশ করার পরপরই আমরা শুনতে পেলাম আইনমন্ত্রীর উক্তি, তার সেই পুরনো কথা। তিনি বললেন, আদালতের রায় হয়ে হওয়ার পর এ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে আমরা কার কথা বিশ্বাস করব? সরকারের মন্ত্রীরা অহরহ এরকম পরস্পরবিরোধী ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই কৌশল তাদের বিবেচনায় মোক্ষম হলেও বাংলাদেশের জনগণ এত বোকা নয় যে, তারা সরকারের আসল উদ্দেশ্যটি বুঝতে সক্ষম নয়। আসল কথা হলো সরকারের মধ্যে একটি ভয় বাসা বেঁধেছে। ভয়টি হলো ক্ষমতা হারানোর। হয়তো তারা ভাবছেন, আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের ক্ষমতার গদি ছাড়তে হবে। ক্ষমতায় না থাকলে তাদের দুশ্চিন্তা হলো তারা নানারকম নিগ্রহের শিকার হতে পারেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় থাকা বা না থাকা সম্পূর্ণভাবেই জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে এবং এটিকে একটি স্বাভাবিক অবস্থা বলেই মেনে নিতে হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ দেশে ক্ষমতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যদিকে ক্ষমতাহারা হওয়া মানে নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হওয়া। ক্ষমতায় গেলে নির্বাহী আদেশে মামলা-মোকদ্দমা নিজেদের ওপর থেকে তুলে নেয়া যায়। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের ওপর বিদ্যমান মামলাগুলো শতগুণে সচল করা যায়। এমনকি নতুন নতুন মামলা-মোকদ্দমার বেড়াজালে ফেলে তাদের নাভিশ্বাস তোলা যায়। এমনটিই ঘটেছে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার প্রতিবাদে বিরোধী দলের কয়েকদিনের হরতালকে কেন্দ্র করে। বিরোধী দলের ডাকা হরতালকে কেন্দ্র করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হয়েছে। ইলিয়াস আলীর নিজ এলাকায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারী জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে তিন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এদিকে রাজধানী ঢাকায় হরতাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাস পোড়ানোর মামলা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ককটেল নিক্ষেপের মামলায় বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের ৩৩ নেতা আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিন না পাওয়ায় কারারুদ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে বহু গ্রেফতার ও মামলা-হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একই দিনে একই সঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিককে জেলে পোরার ঘটনা নজিরবিহীন। এদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দ্রুত বিচার আইনে। এরা যদি শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে তাদের চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। অর্থাত্ তারা ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার ফলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমঝোতা ও সংলাপের পরিবেশ সরকার প্রতিহিংসামূলক আচরণের দ্বারা বিনষ্ট করে ফেলছে। মামলা দুটির বিষয়বস্তুর সত্যতা নিয়ে বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলিরা আদালতের কাছে এরই মধ্যে জোরালো যুক্তি উত্থাপন করেছেন। আদালত এইসব যুক্তি আমলে নেবে কিনা সেটা আদালতের ব্যাপার। আমাদের মত দেশে বিচারবিভাগ শাসনবিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত হতে পেরেছে কিনা সে ব্যাপারেও নানা জনের নানা প্রশ্ন। এ দেশের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সমঝোতা কিংবা সংলাপের পরিবেশের জন্য সব পক্ষই চায় মুক্ত পরিবেশে আলোচনা করতে। কোনো পক্ষই তাদের ঘাড়ের ওপর মামলার খড়গ রেখে কিংবা দণ্ডের বোঝা নিয়ে আলোচনায় বসতে চায় না। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হলো সাংবিধানিক সঙ্কট উত্তরণের জন্য পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান যে গোলটেবিল বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খড়গ কাঁধের ওপর রেখে যোগদান করতে সম্মত হননি। তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে বসার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, সেই প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানী যখন বজ্র-নির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, বাস্তিল দুর্গের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনবেন, তখন জনতার যে রুদ্ররোষ সৃষ্টি হয়েছিল তার আঘাতে আইয়ুব খান তার ওপর থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকটি সফল হয়নি, সেটি এক ভিন্ন আলোচনা। এই ঘটনা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, দমনপীড়নের অভিযান জারি রেখে কোনো সমঝোতা বা সংলাপ হয় না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যে সংলাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, সেটি যদি তার অন্তরের কথা হয় তাহলে তাকে অবশ্যই একটি মুক্ত ও সৌন্দর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিরোধী দলকে শিক্ষা দিয়ে বাগে আনার চিন্তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। দর কষাকষির জন্য হার্ডলাইনে পথ বেছে নিতে গিয়ে দর কষাকষির রশিটাই ছিঁড়ে যায় কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে। ইলাস্টিকের মতো দ্রব্য টেনে লম্বা করা যায় বটে, তবে তারও একটা সীমা আছে। আর উভয়পক্ষকে ছাড় দেয়ার যে কথা, সেটা আমরা উপলব্ধি করতে সক্ষম। উভয়পক্ষ যদি পরস্পরের প্রতি কিছুটা ছাড় দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে সম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে, তার চেয়ে জাতির জন্য এই মুহূর্তে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সফরকারী ভারতের অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখার্জির একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনিও সংলাপের কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ যা চায় সেই অনুযায়ী সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়াই গণতন্ত্রসম্মত। রাজনীতি মানে অত্ঃ ড়ভ পড়সঢ়ত্ড়সরংব। রাজনীতির সেই অত্ঃ-টা যদি বিবদমান সব পক্ষ রপ্ত করতে পারে, তাহলে জয় হবে বাংলাদেশের জনগণের। আমি ভাবতে চাই, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের সব দোষত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জনগণের মুখে হাসিটি দেখতে চান।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com

শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

বিবেকের জয় হোক



ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ্
ছাত্রজীবন ও তত্পরবর্তীকালে বেশকিছুটা সময় রাজনৈতিক সক্রিয়বাদী হিসেবে ভূমিকা পালন করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। একথা সত্য যে, রাজনৈতিক তত্পরতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জ্ঞানার্জনের পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। যারা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা সবাই সাক্ষ্য দেবেন, পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে সমান তালে নতুন সমাজ নির্মাণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। কীভাবে এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। সেটি আমি আন্তরিকভাবে করার চেষ্টা করেছি। রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিশ্বাসের জন্য আমাকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। অনেক বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, কীভাবে আমার বিরুদ্ধমতের শিক্ষকরা আমার একাডেমিক সাফল্যকে তছনছ করে দিতে চেয়েছেন। সেই ক্ষোভ আমাকে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দ্রোহী করে তুলেছিল। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, শিক্ষকের কলমও ঘাতকের ছুরিকায় পরিণত হতে পারে। নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতাই আমাকে একদিন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হওয়ার পথ বেছে নিতে প্রণোদিত করে, কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে আমার হৃদয়ের গহীনে জ্ঞানচর্চার প্রবল আকাঙ্ক্ষাটি লুকিয়ে ছিল। আমি ভাবলাম রাজনীতির সক্রিয় মাঠে না থেকেও ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে আমি আমার চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি ভিন্ন এক পথে। সেটা ছিল শিক্ষকতার পথ। ১৯৭৬ সালে দেশে যখন আমাদের মতো স্বদেশ চিন্তায় মগ্ন মানুষদের জন্য রাজনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, আমি তখন রাজনীতিক হওয়ার মোহ ত্যাগ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যোগ দিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সেই থেকে আরও গভীরভাবে জ্ঞানচর্চায় মনোযোগী হলাম এবং অর্থনীতিশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষাও গ্রহণ করলাম। আমার জীবন নতুন বাঁকে মোড় নিল। আজ অবধি শিক্ষকতার কাজে ব্রতী আছি। তবে আর পাঁচ-দশজন শিক্ষকের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, স্বদেশচিন্তাকে কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। দেশ যখন সঙ্কটে পড়ে তখন আমি উদ্বিগ্ন হই। দেশের সাফল্য দেখে উদ্বেলিত হই।
১৯৬২ থেকে স্বাধীন পূর্ববাংলার স্বপ্ন দেখেছি। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, এই স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবায়িত করা যায় তার জন্য পথ খুঁজেছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে না। স্বাধীনতাই হলো পূর্ববাংলার অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। শুধু স্বাধীনতা নয়, পূর্ববাংলায় একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও স্বপ্ন দেখেছি। আমি বিশ্বাস করতাম, পূর্ববাংলার আকাশে যে সূর্য উদিত হয় সেই সূর্যের নিচে এদেশের প্রতিটি মানুষ একে অপরের ভাই কিংবা বোন। কেউ কারও প্রভু নয়। ১৯৭০-র ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে আমি ও আমার সহকর্মীরা স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার ১১ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করলাম। আজ ভাবতে অবাক লাগে, সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কীভাবে অমন সাহসী হতে পেরেছিলাম। বয়স যত বাড়ছে, যৌবনের দুঃসাহসের কথা ভেবে ততই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ি। এই দুঃসাহসিক কাজটি করার পর খুব বেশিদিন কারাগারের বাইরে কাটাতে পারিনি। ২১ মার্চ ১৯৭০ আমাকে গ্রেফতার করা হলো। ২৭ মার্চ ১৯৭০ সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমার বিচার অনুষ্ঠিত হলো। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সামরিক আদালতের বিচারক জনৈক পাকিস্তানি মেজর রায় ঘোষণা করলেন ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১৫ বেত্রদণ্ড। কারাদণ্ড কিংবা বেত্রদণ্ড কিছুই আমাকে ভীত কিংবা শঙ্কিত করতে পারেনি। সামরিক আদালতের একজন কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর আমাকে অনুরোধ করলেন বেত্রদণ্ড মওকুফের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। তিনি আমাকে বললেন, বেত্রদণ্ড যে কী ভয়ঙ্কর তা কি আপনি বোঝেন? আমি বললাম, নিশ্চয়ই বুঝি। কারণ আমার জানা আছে, আইয়ুবী সামরিক শাসনের সময় বেত্রদণ্ডের ফলে কমরেড কাজী আবদুল বারী বধির হয়ে গিয়েছিলেন। আমার দুঃসাহস দেখে কোর্ট ইন্সপেক্টর আর কথা বাড়ালেন না। সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই বিশ্বের তাবত্ বেতার মাধ্যমে সংবাদটি প্রচার হয়ে গেল। আমার সৌভাগ্য যে, সেই বেত্রদণ্ড দেশবাসীর প্রতিবাদের মুখে কার্যকর করা সম্ভব হলো না। দেখতে দেখতে এক বছরের কারাদণ্ডের মেয়াদও ফুরিয়ে গেল। কিন্তু আমার কারামুক্তি হলো না। আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা কারারুদ্ধ করে রাখা হলো। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হিংস্রতা ও বর্বরতার সূচনা হলো। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কারাভ্যন্তরে অন্তত তিনবার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে, আমার এবং আরও অনেকের জীবনাবসান ঘটতে পারত। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া, তিনি আমাকে আজও এই সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে; মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ কিন্তু সম্প্রতি দেশের যে অবস্থা তাতে বলতে পারি না ক’দিন বাঁচব। এমন অনিশ্চিত জীবনের জন্য কি স্বাধীনতার লড়াই করেছিলাম—এই জিজ্ঞাসা বারবার আমার হৃিপণ্ডকে ক্ষতবিক্ষত করে। মহাজোটের অন্যতম শরিক নেতা জনাব রাশেদ খান মেননও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি এবং অন্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সামনে বলেছেন, তিনি নিজেও তার জীবন নিয়ে নিরাপদ বোধ করেন না। এমন স্বাধীন দেশ, এমন আজাদির স্বাদ আমরা কি চেয়েছিলাম? একটি শোষণমুক্ত স্বাধীন স্বদেশভূমির স্বপ্ন এভাবে কেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে? শুধু ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক আনসার আলীই নয়—গুম বলি, নিখোঁজ বলি তার তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ। অন্তত আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের মতো দায়িত্বশীল মানবাধিকার সংস্থাগুলোও তাই বলছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও প্রচণ্ড উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আজকের বিশ্ব যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে যেন একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং ব্লগগুলোতে এসব ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার ঘাটতি নেই। সরকারের মন্ত্রীরা এ বিষয়ে একেক সময়ে একেক কথা বলছেন। কখনও মনে হয় হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো আশা যেন উঁকি দিচ্ছে, আবার কখনও মনে হয় কোনো আশা নেই, কোনো ভরসা নেই। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাত্ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু এখন দেশবাসী প্রচণ্ড অধিরতা নিয়ে সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক সমস্যাই থাকতে পারে। যেমন বিদ্যুতের সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের সমস্যা; কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়বে—এমনটি কখনোই কাম্য নয়। জীবন অমূল্য, কারণ একটি জীবনের দীপ প্রজ্বলিত করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই একটি স্বাধীন দেশে এটি একটি অলঙ্ঘনীয় অধিকার। এদেশের সাধারণ মানুষ অনেক অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনায় অভ্যস্ত। দু’বেলা আহার না জুটলে কিংবা সম্মানজনক পরিধেয় না থাকলে মানুষ যতটা না সরকারকে দুষে, তার চেয়েও অধিক দুষে নিজ ভাগ্যকে। এরকম একটি জনগোষ্ঠী অবশ্যই তার সবচেয়ে প্রিয় ও মূল্যবান সম্পদ জীবনের অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য মনে করলে তাদের কতটা দোষ দেয়া যায়।
সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দেশ আজ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে চলেছে। অনিশ্চিত বলছি এ কারণে যে, অকারণে প্রাণ হরণের মতো ঘটনা ঘটলে এবং তার চাইতে মর্মন্তুদ প্রাণ-হারানো মানুষটির শেষকৃত্য সম্পাদনের সুযোগ না থাকলে যে ক্ষোভ ও ঘৃণার উদ্ভব ঘটবে, তার প্রতিক্রিয়ায় যদি হিংসা-উন্মত্ততার সৃষ্টি হয়, তাহলে তার পরিণতি আমরা কী করে রুখব? অস্ট্রিয়ার যুবরাজকে হত্যার ঘটনা প্রথম মহাযুদ্ধে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল, তার স্মৃতি এত বছর পরও দগদগে। আজ তাই সব মহলের বোধোদয়ের সময় এসেছে। আমি উপলব্ধি করতে পারি, ক্ষমতাসীন মহলের মধ্যে বহুজন আছেন যারা দেশে কোনো ট্র্যাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব হোক তা কায়মনোবাক্যে চান না। একটি গ্রন্থ রচনা করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে; কিন্তু তার পাণ্ডুলিপি মুহূর্তের মধ্যে দীপশলাকার আগুনে ভস্মীভূত করা সম্ভব। আমাদের এই বাংলাদেশ অযুত প্রাণের বিনিময়ে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য আমাদের অনেককে, যারা বেঁচে আছে, অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই জীবদ্দশায় দেশটি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে—এটা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না। এদেশে বিবেকবান মানুষ আছে। দলীয় আনুগত্যে অন্ধ নন, এমন বুদ্ধিজীবীও অনেকেই রয়েছেন। তাদের সবার কাছে আমার একান্ত নিবেদন—আসুন আমরা মতাদর্শ নির্বিশেষে একজোট হয়ে উচ্চারণ করি : বাংলাদেশে মানুষের জীবনের মূল্য হোক সব মূল্যের ঊর্ধ্বে। কারোর ভুল বা বিচ্যুতির জন্য দেশটিকে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই না—কারণ কী ক্ষমতাসীন, কী ক্ষমতাবহির্ভূত কারোরই কোনো মঙ্গল নেই এতে। বিবেকের জয় হোক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mail: mahbub.ullah@yahoo.com

শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১২

এদের ধরা সাধ্য কার



ড. মাহ্বুবউল্লাহ্
বাংলাদেশ রেলওয়েতে এখন বিপুল সংখ্যায় নিয়োগ চলছে। ওয়েম্যান, নাম্বার টিকার, খালাসি, জুনিয়র অডিটরসহ বিভিন্ন পদে সাড়ে ৭ হাজার লোক নিয়োগ চলছে। একটি দৈনিকের রিপোর্টে জানা যায়, ‘এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্য। চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়। এ ঘুষের টাকা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বণ্টন চলছিল। ওই ঘুষের টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা ও পশ্চিমাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন।’ এই তথ্য কতটুক নির্ভরযোগ্য তা প্রমাণসাপেক্ষ। এদেশে শুধু নিয়োগ বাণিজ্যই হয় না, হয় আরও বহুবিধ ধরনের বাণিজ্য। যেমন—ভর্তি বাণিজ্য ও টেন্ডার বাণিজ্য। বাণিজ্যের প্রকরণের কথা বলতে গেলে আরও কয়েক ধরনের বাণিজ্যের কথা বলা যায়। যারা এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, তারা হয়তো তাদের এই অপকর্মের যৌক্তিকতা দিতে গিয়ে বলবেন সেই পুরনো প্রবাদবাক্যটি : বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। মহাজনদের অমোঘ বাণী ধারণ করেই তো তারা এগিয়ে চলেছেন। রমরমা এ বাণিজ্যে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও দেশ দ্রুত ধাবমান রসাতলের পথে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক দশক ধরে রেলওয়ে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। প্রতি বছর বিশাল লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। নিয়োগ নিয়ে যখন বাণিজ্য হয় তখন যে কোনো প্রতিষ্ঠানের অবধারিত নিয়তি হলো ধ্বংস ও বিনাশ। কারণ নিয়োগ বাণিজ্যের পথ ধরে যারা নিয়োগ পান তারা যে অযোগ্য-অথর্ব এবং অদক্ষ, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে? এসব অযোগ্য অথর্ব অদক্ষ লোক আর যাই করতে পারুক আমাদের শ্রীহীন রেলওয়েকে শ্রী নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। তাছাড়া প্রচুর অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়ার পর এদের ধ্যান-জ্ঞান ও চিন্তা হয়ে পড়বে কী করে কত দ্রুত নিয়োগ লাভে ব্যয়িত এই অর্থ পুনরুদ্ধার করা যায়। কখনও কখনও লক্ষ্য থাকে এর দু’চার-দশগুণ টাকা তুলে নেয়ার। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির উত্তরোত্তর দুর্দশায় নিপতিত হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না।
বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক দর্শনে পরিচালিত হচ্ছে, তাকে পুঁজিবাদী দর্শনই তো বলতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে একটি অনগ্রসর স্বল্পোন্নত দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশও উন্নয়নের দ্বার অবারিত করে দিতে পারে। তবে পণ্ডিত ব্যক্তিরা অনেকে মনে করেন—ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ যেসব দেশে ক্লাসিক্যাল ধারায় পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে, তারপর অনগ্রসর দেশগুলোতে স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশ সম্ভব নয়। এসব দেশে যে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে সে পুঁজিবাদকে নির্ভরশীল পুঁজিবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। বিতর্কের জটিলতায় প্রবেশ না করে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বেশ শক্তিশালী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ভারত, চীন, রাশিয়া ও ব্রাজিলেও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাণবন্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ক’দিন আগে এ ৪টি দেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের একটি সম্মেলন হয়ে গেল। সম্মেলনটি যে ফলপ্রসূ হয়েছে সে ব্যাপারে ৪টি দেশের নেতারাই সহমত প্রকাশ করেছেন। বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়পরতা ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। শত হতাশার মধ্যেও এটি একটি সুসংবাদ। অনেকেই মনে করেন, জাতীয় অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের আরোপিত শৃঙ্খল শিথিল হওয়ার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে সৃজনশীলতা ও উদ্যমের যে জোয়ারের সূচনা হয়েছে, সেই জোয়ারই বাংলাদেশকে উন্নয়নের টেক অফ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধির হার আরও ২ কি ৩ শতাংশ বাড়াতে পারলে অর্থনীতির আকাশ-খেয়াটি ঊর্ধ্ব আকাশে বিচরণ শুরু করবে। এসব ভালো কথা, সুসংবাদও বটে। পুঁজিবাদী বিকাশের জন্য পুঁজির প্রয়োজন। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যেদিন বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে, সেদিন এদেশের ক’জনের হাতে পুঁজি ছিল? হাতেগোনা দু’চারজন কোটিপাতি হয়তো ছিলেন। কিন্তু এখন হাজার কোটির মালিকের সংখ্যা কত তা কেউ বলতে পারবে না। তবে সংখ্যাটি যে বেশ বিশাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অপরাহ্ন থেকেই বাংলাদেশে আমরা একশ্রেণীর লুটেরা গোষ্ঠীর তাণ্ডব লক্ষ্য করি। সেদিন থেকেই অবাঙালিদের বাড়ি-গাড়ি-অর্থকড়ি লুটতরাজের মচ্ছব শুরু হয়। লুটতরাজের মচ্ছব স্বাধীনতার ৪০ বছরেও থেমে যায়নি। দার্শনিকরা বলেন, সব ধরনের সম্পত্তির পেছনে থাকে একটি পাপের অধ্যায়। ফরাসি দার্শনিক প্রুবোঁ বলেন, Property is theft. কারণ সৃষ্টিকর্তা তো আমাদের কাউকে সম্পদ ও সম্পত্তির দলিল হাতে দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাননি। তাহলে কীভাবে কেউ হলো বিলিয়নিয়ার, আবার কেউ হলো নিঃস্ব দরিদ্র। এই প্রশ্নের জবাব আমরা সমসাময়িক বাংলাদেশের দিকে তাকালেই খুঁজে পেতে পারি। মানুষের দুর্দশাকে পুঁজি করে এদেশে অনেকে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। দুর্নীতি, দুরাচার, চোরাকারবার, মাদক পাচার, কর ফাঁকি, ঋণখেলাপি হওয়া, মানব পাচার, আদম ব্যবসা, শেয়ারবাজারে জালিয়াতি থেকে শুরু করে হরেকরকম বাণিজ্যের পথে একশ্রেণীর মানুষের হাতে অবৈধ অর্থের পাহাড় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তা না পেলে এরকমটি সম্ভব হতো না। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যকে ব্যবহার করে এদেশে খুব বাজে ধরনের পুঁজিবাদ যাকে বলা যায়, Crony Capitalism গড়ে উঠেছে। Crony capitalism-এর প্রক্রিয়ায় যে অর্থাগম হয়, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশে বিনিয়োগ হয় না, দেশেও থাকে না। সেটাই সবচাইতে উদ্বেগের বিষয়। যদি এই অর্থ বিদেশে পাচার না হয়ে দেশে থাকত এবং দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চেহারা অনেক বেশি সুশ্রী হতে পারত। সাধারণ মানুষও বিনিয়োগ ও পুঁজিসহায়ক শক্তি হিসেবে কর্মসংস্থান পেত। এর ফলে দারিদ্র্য কিছুটা হলেও ঘুচত ও অর্থনীতিতে একটি উত্পাদনমুখী এবং আরও জোরালো প্রবৃদ্ধিমুখী প্রক্রিয়ার সূচনা হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের হাতে তারা শুধু আদিম পুঁজি কীভাবে সঞ্চিত করা যায় সে কথাই ভেবেছে, এর সদ্ব্যবহার ও বিনিয়োগের কথা ভাবেনি। এমনকি জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়ানোর নাম করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে কুইক মানির কথাই ভেবেছে। তবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সুবাদে নিয়োগ বাণিজ্যের মতো বহুবিধ অনৈতিক পথে অর্থবিত্ত করাটা এখন এক ধরনের আভিজাত্যে পরিণত হয়েছে। এই শ্রেণীর মানুষের বিত্ত-বৈভব, বাড়ি-গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, নামিদামি হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানাহার আমরা সমীহের দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু বৈভবের এরকম নোংরা প্রদর্শনীর কোনো প্রতিবাদ হয় না। তরুণ সমাজকেও বিত্তমুখী চিন্তায় আবিষ্ট করে প্রতিবাদের পথ থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে।
গত ১০ এপ্রিল একটি নোয়া গাড়িতে রেলমন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতে যাওয়ার পথে তার এপিএস ওমর ফারুক এবং পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা গাড়ি চালকের উপস্থিত বুদ্ধির কারণে বিজিবির ৪ নম্বর গেটে ৭০ লাখ টাকাসহ আটক হয়েছেন। এই ঘটনাটি বিশাল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্যে পরস্পরবিরোধিতা স্পষ্ট। সবাই চাচ্ছে কিছু একটা ঢাকতে। পত্র-পত্রিকায় যেসব খবর চাউর হয়েছে তা থেকে অনেকেই সন্দেহ করছেন, এই অর্থের গন্তব্যস্থল ছিল খোদ রেলমন্ত্রীর বাসা। কিন্তু বিষয়টি তদন্ত ও প্রমাণসাপেক্ষ। রেলমন্ত্রী পরদিন সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি বিজিবির হাতে দুই কর্মকর্তা আটক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ওই টাকার মালিক এপিএস ওমর ফারুক। যদিও গত ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি আমার দেশকে বলেছেন, কিসের টাকা তা আমি জানি না। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, সোমবার গভীর রাতে টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় ওমর ফারুকের চালক তাকে অপহরণের চেষ্টা করেন। এসময় ভয়ে জীবন বাঁচাতে তিনি বিজিবির সদর দফতরের ভেতরে প্রবেশ করেন। মন্ত্রী আরও জানান, গাড়ির ভেতরে রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা ও এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ছিলেন। তবে এ মুহূর্তে তারা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছেন। এত টাকা ওমর ফারুকের কাছে কীভাবে এলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজের টাকা নিজের সঙ্গে রাখার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কারণ তার টাকা তিনি কোথায় রাখবেন, নিজের সঙ্গে রাখবেন নাকি বাসায় রাখবেন, তা তার ব্যাপার। তবে কোনো অন্যায় আছে কি-না, তা তদন্ত করলেই বের হয়ে আসবে। যদি তার অর্থের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু থাকে, তা খতিয়ে দেখবে এনবিআর। এটা আমাদের বিষয় নয়। এর সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি দু’জনের কথা।’ গভীর রাতে মন্ত্রীর বাসায় তারই মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তার যাওয়া প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আমার কাজ শেষ করে বাকি সময় তাদের। তারা কোথায় যায়, কী করে—এটা তাদের নিজেদের ব্যাপার। তাদের শাস্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের অপরাধ নিরূপণের আগে শাস্তি দেয়া ঠিক হবে না। রিপোর্ট পেলে স্পষ্ট হবে, তারা অপরাধী কি-না। এরপরই ব্যবস্থা। ঘটনার আসল সত্য যাই হোক না কেন, দৈনিক প্রথম আলো ১২ এপ্রিল সংবাদের ফার্স্ট লিড করে শিরোনাম করেছে, ‘অভিযোগের তির সুরঞ্জিতের দিকে—টাকার থলে নিয়ে মন্ত্রীর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা—এপিএস বরখাস্ত।’ সুরঞ্জিত বাবুর মতো একজন ঝানু পলিটিশিয়ান এই মুহূর্তে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে তার নিজ ও তার দলের ইমেজ কিছুটা হলেও সুরক্ষিত করতে পারেন। এ নিয়ে বিলম্ব করলে অভিযোগের তীর আরও তীব্র ভেদী হবে।
সাম্প্রতিককালে রেলের নিয়োগ বাণিজ্য বেশকিছু মানবিক ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করেছে। দৈনিক প্রথম আলো নিয়োগ বাণিজ্য সম্পর্কে ১২ এপ্রিল রিপোর্ট করেছে, ‘অভিযোগ উঠেছে, একেকটি পদের জন্য সর্বনিম্ন আড়াই থেকে সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে নিয়োগ কমিটির প্রধান ইউসুফ আলীর মাধ্যমে। আবদুল কাদির নামের এক ব্যক্তি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে জুনিয়র নিরীক্ষক পদে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হন। এরপর রেলের কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ‘৬ লাখ টাকা দিলেই নিয়োগপত্র হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে। নইলে যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। কাদির জানান, টাকা না দেয়ায় তার চাকরি আর হয়নি। এ কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গত ২১ মার্চ প্রতিকার চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠির ভিত্তিতে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাগাদা দেয়া হয়েছে। রেলওয়ের নিরীক্ষক ইস্কান্দার আলী হাওলাদারের মেয়ে জুনিয়র নিরীক্ষক পদের প্রার্থী ছিলেন। মেয়ের চাকরির জন্য তার কাছ থেকেও ৬ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিয়ে মেয়ের চাকরি নিতে রাজি ছিলেন না তিনি। পরে আর চাকরি হয়নি।’ এসব করুণ কাহিনী এখন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এর কী জবাব আছে? বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হয়ে রেলওয়ের কালো বিড়ালটি খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, এবার সত্যিই কালো বিড়ালটি ধরা পড়বে। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে বহু পাঠক ৭০ লাখ টাকা ধরা পড়া নিয়ে মন্তব্য করেছেন। একজনের মন্তব্য—‘আচ্ছা, আপনি নিজেই তাহলে সেই কালো বিড়াল। ন্যূনতম লজ্জা থাকলে পদত্যাগ করুন।’ মন্তব্যটি জনৈক আলী হাসানের। অপর পাঠক আবদুল হালিম মিয়র মন্তব্য—‘রেলমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগ চাই। সভ্য সমাজে, সভ্য দেশে এটাই রীতি।’ এদেশে কালো বিড়ালের অনুসন্ধান সত্যিই কঠিন। অজস্র কালো বিড়ালের দেশে অন্যরা অসহায়। যে সমাজ, যে দেশ আদিম পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ায় নিক্ষিপ্ত হয়; সে দেশে ও সে সমাজে কালো বিড়ালদের দুধকলা দিয়ে পোষা হয়। এদের ধরা সাধ্য কার?
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mahbub.ulla@yahoo.com