শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

সুযোগ এখন প্রধানমন্ত্রীর করতলে



ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ্
গত ২ জুন দৈনিক আমার দেশ-এ ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় কি রক্ষা পায়’ শিরোনামের কলামটি ছাপা হয়েছিল। এই লেখার সর্বশেষ লাইনটি ছিল, ‘তবে এটুকু বুঝতে পারছি, ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যা কিছু চত্বফরপঃ করতে পেরেছি, এখন সেরকম কিছু করতে পারা প্রায় অসম্ভব।’ আমরা যে একটা অনিশ্চিত সময় পার করছি, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনীতি শাস্ত্রে একটি কথা আছে—ঝুঁকি সম্পর্কে চত্ড়নধনরষরঃু বা সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে হিসাব কষে কিছু বলা যায়, কিন্তু অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রে সেরকম কিছু বলা যায় না। তাই অনিশ্চয়তা একেবারেই পরিমাপযোগ্য নয়।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে সর্বশেষ পরিণতি কীভাবে আসতে পারে সে সম্পর্কে জোরালোভাবে আঁচ-অনুমান করা সহজতর ছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি এতই জটিল যে এই পরিস্থিতির গর্ভ থেকে কেমন সন্তানের জন্ম হবে, সে সম্পর্কে ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গুনার মির্ডালের ভাষায় একটি ঝড়ভঃ ংঃধঃব বা কোমল রাষ্ট্র বলা যায়। এরকম একটি রাষ্ট্রে দেশের ভেতরের এবং বাইরের অনেক ধরনের কুশীলবরা তত্পর থাকে। তাদের বহুমুখী তত্পরতা শেষ পর্যন্ত দেশটিকে কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে, তা বলার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা আমার আছে বলে মনে হয় না। কারণ কোনো একজন অপঃড়ত্ কিছু একটা করতে চাইলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অপঃড়ত্ বা অপঃড়ত্-রা উল্টো চাল চালে। এর ফলে অবিরত ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। শেষ ফল যা আসে তা হয়তো এসব অগণিত ক্রিয়া-বিক্রিয়ারই একটি পরিণতি। কিন্তু ক্রিয়া-বিক্রিয়াগুলোর প্রতিটি ধাপ বা পর্যায় চয়ন করে চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে বলা সত্যিই কঠিন। কারণ বিষয়টি ঈযবসরংঃত্ু বা রসায়ন শাস্ত্র নয়, যেখানে সমাজবদ্ধ মানুষের মনে নিরন্তর নানামুখী প্রবণতার সৃষ্টি হয় এবং তারই সমান্তরালে রাষ্ট্রবহির্ভূত অপঃড়ত্-রাও নানামুখী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, সেখানে রসায়ন শাস্ত্রের মতো কোনো সিদ্ধান্তে আসা সত্যিই দুরূহ।
অস্বীকার করার উপায় নেই বাংলাদেশ এই মুহূর্তে তিনটি বৃহত্ শক্তির স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। শক্তিগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং গণচীন। এছাড়াও রয়েছে আরও কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ বহিঃশক্তি, যেমন—সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং মিয়ানমার। বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা কম নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর মতো সামরিক জোট তো রয়েছেই। অন্যদিকে ভারত ও চীন দুটি উদীয়মান শক্তি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল অভিন্ন সীমান্ত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে ভারত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ভারতকে নিয়ে এদেশের মানুষের উদ্বেগের পরিমাণও কম নয়। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে আস্থার সঙ্কট। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভারতের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থের বিচারে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অমীমাংসিত সমস্যার তালিকাটিও দীর্ঘ। এতকিছুর পরও বাংলাদেশ সরাসরি ভারতের বৈরিতার ব্যয় বহনে সক্ষম নয়, কারণ ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বন্ধু নির্বাচন করা গেলেও প্রতিবেশী নির্বাচন করা যায় না, এটি এক নিষ্ঠুর সত্য। গণচীন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেকে একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। গণচীন এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। গণচীনের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার বিবেচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও হিসাবের মধ্যে নিতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বাস্তবতাকে অবহেলা করতে পারে না। গণচীন ভারতের মতো বাংলাদেশের সীমান্ত সন্নিবিষ্ট রাষ্ট্র না হলেও এর ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের খুবই কাছাকাছি।
বাংলাদেশের সঙ্গে গণচীনের স্বাভাবিক বাণিজ্যিক লেনদেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৭৫-এ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তবে কখনও কখনও যে টানাপড়েনের ঘটনা ঘটেনি, এমনটি বলা যাবে না। গণচীনের Department of Policy Planning, Ministry of Foreign Affairs থেকে প্রকাশিত China’s Foreign Affairs-2011 গ্রন্থের বাংলাদেশ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে, Military-to-military exchanges and cooperation produced tangible outcome. গণচীন এখন বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়াল রেলসড়ক নির্মাণে আগ্রহী। এ দুটি অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মাণে যদি বাংলাদেশ ও চীন সরকার সম্মত হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে। শীতল যুদ্ধের সময় আটলান্টিক মহাসাগর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রণনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। ভারত মহাসাগর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে আটলান্টিকের চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরেরই অংশ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাংলাদেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভারত এখনও ভারত মহাসাগরকে ইন্ডিয়ান লেক হিসেবেই দেখতে চায়। ভারতের আশঙ্কা, গণচীন পাকিস্তানের গুরাদর এবং শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে এবং বাংলাদেশেও আরেকটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উত্সাহ প্রকাশ করে ভারতকে জরহম ড়ভ চবধত্ষ দিয়ে আবদ্ধ করে ফেলতে চাইছে। গণচীনেরও আশঙ্কা, তার উচ্চ অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য জ্বালানি তেলের সরবরাহ ভারত মহাসাগর দিয়ে অব্যাহত রাখা ভবিষ্যতে নানামুখী সামরিক বাধার সম্মুখীন হতে পারে। এজন্যই গণচীন তার জাতীয় স্বার্থে জ্বালানি তেল সরবরাহ ঝুঁকির মুখে ফেলতে চায় না। এভাবে বিভিন্ন শক্তির স্বার্থ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নিলে আমাদের বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, আমরা এখন বিপরীতমুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। এই অবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে কারও শত্রুতার মুখোমুখি না হয়ে নীতিনির্ধারণ করা সত্যিই কঠিন। আমাদের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হচ্ছে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি একসময় বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে পরিণত করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। এখন দেখার বিষয় তদীয় দুহিতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবার প্রত্যয়কে সমুন্নত রাখতে কী পদক্ষেপ নেন। তবে তার সরকার যে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি, তা একরকম বলা যায়।
বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহী বহিঃশক্তিগুলোর পারস্পরিক অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ঘটনাপ্রবাহের ওপর উল্লেখযোগ্য ছাপ ফেলবে বলে ধারণা করা যায়। জ্যামিতি শাস্ত্রে আছে, ত্রিভুজের দুটি বাহুর যোগফল তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর। যে ৩টি প্রধান বহিঃশক্তির কথা আলোচনা করা হলো সেগুলোর দুটির মধ্যে যদি কোনো বোঝাপড়া হয় তাহলে হয়তো বাংলাদেশকে সেই পথেই এগুতে হবে। কারণ বাংলাদেশে এখনও এমন কোনো জনঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটেনি যে শক্তি এ ধরনের বোঝাপড়াকে আমলে না নিয়ে শুধু স্বদেশের স্বার্থের কথা ভেবে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে। এটা আমাদের জাতীয় দুর্বলতা। অতি সম্প্রতি ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ‘বাংলাদেশ : ব্যাক টু দ্য ফিউচার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রত্যাশায় ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণ বিপুল উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু দলটি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের গতানুগতিক ধারায় ফিরে যায় এবং দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এ কারণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা বাতিল হয়ে যায়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দেশটির রাজপথে সহিংস বিক্ষোভ অব্যাহত থাকতে পারে। ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা সিডনি জোনস বলেন, সমঝোতার সামান্য সুযোগ এখনও রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বিরোধী দলের কাছাকাছি পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচনে একচ্ছত্র জয় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলটিকে নিয়ে দেশের জনগণের মোহ গত ৩ বছরেই কেটে গেছে। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেয় এবং বিরোধী দলের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সংবাদ মাধ্যম, নিরাপত্তাবাহিনী ও বিচার বিভাগের ওপর সরকার বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করে। আগামী নির্বাচন নিয়ে যে কোনো ধরনের অচলাবস্থার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর রাজধানীতে সহিংসতা চলতে থাকলে পূর্ণমাত্রায় সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা না থাকলেও সামরিক হস্তক্ষেপ জনসমর্থন পেতে পারে। ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পল কিন জজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সুযোগ একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। তবে এজন্য রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপির আটক নেতাদের মুক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই উদ্যোগের সূচনা করতে পারেন। অন্যথায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র আবারও সেই হুমকির মধ্যে পড়বে।
এই কলাম যখন লিখছিলাম তখনই সংবাদ পেলাম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য কয়েকজন নেতা জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বিএনপি সহিংসতাকে এড়াতে চায় বলেই সরকারকে গত ১১ জুন আরও সময় দিয়েছে। এখন সমঝোতায় পৌঁছানোর সুবর্ণ সুযোগটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার করতলে অবস্থান করছে। আশা করি তিনি এই সুযোগ হাতছাড়া না করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের অশুভ আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করবেন। তার জন্যই সেই মহান উক্তিটি স্মরণ করি : চবধপব যধঃয যবত্ ারপঃড়ত্রবং সড়ত্ব মষড়ত্রড়ঁং ঃযধহ ঃযধঃ ড়ভ ধিত্.
লেখক : অর্থনীতিবিদ
mail: mahbub.ullah@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন